ন্যাশনাল টোব্যাকো কন্ট্রোল সেল (এনটিটিসিসি)-স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন, বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বি.আই.পি), বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ্ সাইন্স, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, হেলথ্ব্রিজ-কানাডা, নাটাব, জাতীয় বাতজ্বর ও হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), দি পিপলস্ ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, দি ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর সম্মিলিত উদ্যোগে ৪ জানুয়ারি ২০১৬ রাজধানীর খামারবাড়ীতে অবস্থিত কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে “তামাক নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্মেলন’’ অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলন লক্ষ্য করে যে:
(১) বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে মৃত্যূর হার ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপরিকল্পিত অবকাঠামো, অনঅন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন না হওয়ায় এই ঝুঁকি বৃদ্ধির কারণ। এগুলোর পাশাপাশি সকল ধরনের তামাজাত দ্রব্যের ব্যবহার অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে বিশেষ করে নীতি ও আইন প্রণয়ন এবং বিভিন্ন ধরনের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। দেশে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন ও সময়োপযোগী, কার্যকর সংশোধন এর অন্যতম উদাহরণ। আইনটির প্রয়োগ ও পালনের দিক থেকেও বাংলাদেশে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে।
(২) তামাক কোম্পানীসহ বিভিন্ন ধরনের বানিজ্যিক তৎপরতার কারণে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা বিশেষ করে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। এ সকল বানিজ্যিক তৎপরতাকারীদের কখনও কখনও সরকারের নীতি ও আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি এবং বিদ্যমান নীতি ও আইন ভঙ্গ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের অপকৌশলও প্রয়োগ করতে দেখা যায়। মানুষকে তামাক সেবনে উদ্বুদ্ধ করতে কোম্পানীগুলো কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে চটকদার ভাষা প্রয়োগে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রচারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
(৩) তামাক নিয়ন্ত্রণ ক্ষেত্রে অগ্রগতির জন্য সারাদেশে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী সংগঠনগুলির ধারাবাহিক কার্যক্রম অবদান রাখছে। বিশেষ করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন, সংশোধন ও বিধিমালা প্রণয়ন এবং তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির জন্য দাবি উত্থাপন, তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি এবং আইন বাস্তবায়নে সচেতনতা বৃদ্ধিতে স্থানীয় পর্যায়ের সংগঠনগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইতিমধ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত সংগঠনগুলি স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, সুস্থ পরিবেশ, পরিকল্পিত অবকাঠমোগত উন্নয়ন এবং অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নে কাজ করে চলেছে।
(৪) দেশের স্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনা এবং পদেক্ষপসমূহ মূলত চিকিৎসাকেন্দ্রিক। বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে প্রতিরোধের থেকে চিকিৎসাকে অধিক প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য বলতেই হাসপাতাল , আসনসংখ্যা, চিকিৎসক, সেবক, যন্ত্রপাতি, ঔষধপত্র এই বিষয়গুলিকে বোঝানো হচ্ছে। যে কারণে বছর বছর স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরও এ খাতে সঙ্কট থেকেই যাচ্ছে। অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা পাওয়ার সুবিধার বিপরীতে সুস্থ থাকার পরিবেশ তৈরি জরুরী হয়ে পড়েছে। সুস্থ জাতি গড়ে তোলার জন্য নিরাপদ খাদ্য, বিশুদ্ধ মাটি, নির্মলবায়ূ, বিশুদ্ধ পানি, তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ, হাঁটাচলার পরিবেশ ও খেলাধুলার মাঠ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
(৫) জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে সমাজের সকল জাতি, সম্প্রদায়, আয়, বর্ণ এবং শারীরিক সক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তির বিষয়েও মনযোগী হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে প্রতিবন্ধি ব্যক্তি, নারী, শিশু ও বয়স্ক ব্যাক্তিদের জন্য বিশেষ কিছু চাহিদা থাকলেও সর্বত্রই তারা প্রায় অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। নীতি ও আইন দ্বারা তাদের জন্য সুবিধা তৈরির বিষয়ে দিক নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবায়নের অভাবে তার সুফল পাওয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
(৬) তামাক নিয়ন্ত্রণ, হাঁটাচলার উপযোগী পরিবেশ তৈরি, খেলার মাঠ/পার্ক নিশ্চিত করা, নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি এবং সর্বোপরি রোগ প্রতিরোধে অর্থ বরাদ্দের কথা উঠলে বাজেট ঘাটতি দেখানো হয়। এজন্য টেকসই অর্থায়ন (সাসটেইনেবল ফান্ডিং) নতুন দিক উন্মোচনে সাহায্য করবে। টেকসই বা অব্যহত অর্থায়নের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম অস্ট্রেলিয়াতে প্রথম শুরু হলেও থাইল্যান্ড ও নেপালসহ প্রায় ২৫টি দেশে এটি জনপ্রিয়। বর্তমানে বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্যের উপর ১% সারচার্জ আরোপ করা হয়েছে। এভাবে অন্যান্য স্বাস্থ্য ক্ষতিকরপণ্যগুলি যেমন: এসি, কোমলপানীয়, ফাস্টফুড, প্রাইভেট কার অর্থাৎ যে খাতগুলি স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে সেগুলির উপর স্বাস্থ্যকর আরোপ করে টেকসই অর্থায়নের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধে কাজ করা সম্ভব।
এই প্রেক্ষাপটে সম্মেলন কর্তৃক নিন্মোক্ত সুপারিশ তুলে ধরা হলো। যা রাষ্ট্র ও জনগণ দ্বারা অতি দ্রুততার সাথে বাস্তবায়ন জরুরী:
ক) জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে সমাজের সকল জাতি, সম্প্রদায়, আয়, বর্ণ এবং শারীরিক সক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিসহ সকলকে বিবেচনায় নিতে হবে
খ) চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধকে প্রাধান্য দেওয়া এবং এজন্য নিরাপদ খাদ্য, বিশুদ্ধ মাটি, নির্মলবায়ূ, বিশুদ্ধ পানি, হাঁটাচলার পরিবেশ ও খেলাধুলার মাঠ নিশ্চিতকরা এবং তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা
গ) ব্যক্তিগতভাবে:
- পরিবারের সদস্য, আত্মীয় স্বজন এবং সহকর্মীদেরকে তামাক সেবন ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণে নিরুৎসাহিত এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যের প্রচলন করা
- সংশ্ল্ষ্টি নীতি ও আইন পালনে উৎসাহিত করা
- গ্রাম ও শহরে শাক সবজি চাষের উদ্যোগ গ্রহণ এবং অন্যদের উৎসাহিত করা
-নিয়মিত হেঁটে যাতায়াত এবং শিশুদের হেঁটে যাতায়াতে উদ্বুদ্ধ করা
- খেলার মাঠ ও পার্কে খেলাধুলা এবং ব্যয়ামের জন্য গমন করা
- সোশাল মিডিয়াতে প্রচারণা চালানো
ঘ) সামাজিক/স্থানীয়ভাবে:
- তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করা; হাঁটার ক্লাব করা
- খেলার মাঠ ও পার্কে বিভিন্ন ধরনের আয়োজন করা
- কমিউনিটিভিত্তিক শাক-শব্জি-ফলমূল উৎপাদন এবং বিক্রির ব্যবস্থা করা
- ফাস্টফুড ও কোমলপানীয় ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বৃদ্ধি করা
- প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে কাজ করা
ঙ) জাতীয় পর্যায়ে:
- তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন ও পালনে উৎসাহিত করা
- স্বাস্থ্য নীতিমালা, নিরাপদ খাদ্য আইন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও অধিকার আইন, নারী নীতিমালা, জাতীয় সমন্বিত বহুমাধ্যম ভিত্তিক পরিবহন নীতিমালা, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, সিটি করপোরেশন আইন, খেলারমাঠ ও জলাধার সংরক্ষণ আইনসহ সংশ্লিষ্ট সকলনীতি ও আইনসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনে সংশোধন ও নতুনভাবে প্রণয়ন করা
- স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, খাদ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ ও বনমন্ত্রণালয়, স্থানীয়সরকার, বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, পরিকল্পনা অধিদপ্তর/কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ সমন্বয়ের মাধ্যমে কর্মকান্ড পরিচালনা করবে
- অস্বাস্থ্যকর পণ্যদ্রব্যের উপর স্বাস্থ কর আরোপের মাধ্যমে টেকসই তহবিল/অর্থায়ন (সাসটেইনএবল ফান্ডিং) নিশ্চিত করা
- সরকার কর্তৃক হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন গঠন করা এবং এ লক্ষ্য অর্জনে বেসরকারী সংস্থাসমূহের উদ্যোগে একটি মঞ্চ/কমিটি গঠন করা
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান/কর্মস্থল/পার্ক-মাঠ-বিনোদন কেন্দ্র/রাস্তাঘাট/যানবাহন সর্বত্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা
- নারীদের বিশেষ চাহিদার উপর লক্ষ্য রেখে তাদের স্বচ্ছন্দে ও স্বাধীনভাবে হাঁটা ও চলাফেরার পরিবেশ তৈরি করা
- নগরে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলের সর্বত্র নিরাপদে ও স্বচ্ছন্দে হেঁটে যাতায়াতের সুবিধা নিশ্চিত করা
- তামাকের ব্যবহার ও তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করা
- সতেজ শাক-শব্জি-ফলমূল উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করা; কৃষিতে রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং জৈব সার ব্যবহারের ব্যবস্থা করা
- নগরে কৃষি জমি সংরক্ষণ করা
- স্থানীয় পর্যায়ে বাজার ব্যবস্থা চালু করা
- হকারদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা
- ফাস্টফুড, কোমলপানীয়এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করা
- অস্বাস্থকর খাদ্যদ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ/বন্ধ করা
- শুধ ুব্যায়াম নয় যাতায়াতের জন্য হাঁটার অবকাঠামো নির্মাণ করা
-পার্ক/খেলার মাঠে তৈরি ও সংরক্ষণ করে সেখানে সকলের প্রবেশগম্যতা এবং ব্যবহার উপযোগী অবকাঠামো এবং উপকরণ নিশ্চিত করা
- প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ ও গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা
- কারখানা সৃষ্ট পানি ও বায়ূ দূষণ প্রতিরোধ করা
ঘোষনা:
সরকার চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধকে প্রাধান্য দিয়ে নীতি, আইন, পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা, তদারকি, বাজেট, অবকাঠামোগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে। সরকার তামাক কোম্পানী এবং অন্যান্য বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অপকৌশল প্রতিহত করে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভূমিকা রাখবে। সেই সঙ্গে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে সম্পৃক্ত করে এই কার্যক্রমকে জোরালো করবে এবং ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করবে। এ লক্ষ্যে সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সংগঠনসমূহের উদ্যোগে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে ধারাবাহিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে। যা জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন তথা সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশ ও জাতির অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখবে।