সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের ওপর সুনির্দিষ্ট করারোপ করা হলে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণে বড়ো ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে রাজস্ব ফাঁকি রোধ করতে সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি বন্ধের পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী অতিদ্রুত একটি শক্তিশালী জাতীয় করনীতি প্রণয়ন প্রণয়ন করতে হবে।
আজ বুধবার (১৬ নভেম্বর ২০২২) সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মিয়া হলে এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট, বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি, বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ও ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট যৌথভাবে ‘তামাক কোম্পানির বহুল প্রচারিত রাজস্ব মিথ এবং তুলনামূলক বিশ্লেষণ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক -এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ডিপার্টমেন্ট অব ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের গবেষক ডা. মাহবুবুস সোবহান। গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, দ্য ইউনিয়নের কনসালটেন্ট ফাহিমুল ইসলাম, ভাইটাল স্ট্রাটেজিসের কান্ট্রি ম্যানেজার মো. নাসির উদ্দিন শেখ, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারী ও কর্মসূচি প্রধান সৈয়দা অনন্যা রহমান। এছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমের অর্ধশতাধিক সাংবাদিকবৃন্দ ও তামাক বিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিনিধিগণ সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
সম্মেলনে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে মূলত দুইটি বিদেশি কোম্পানি দেশের তামাক ব্যবসার সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই কোম্পানিগুলো তাদের বাণিজ্য প্রসারের জন্য আমাদের দেশকে বেছে নিয়েছে। তারা শুধু এদেশ থেকে লভাংশ্যই নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ দেশে যে রোগের ব্যয়, রোগাক্রান্ত ব্যক্তি এবং যে অর্থনৈতিক ক্ষতি, পরিবেশের ক্ষতি, তামাক চাষের কারণে অন্যান্য ক্ষতির দায় কোনভাবেই তারা নেয় না। সুতরাং আমাদের তামাকের মত ক্ষতিকর পণ্যের পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর পণ্য ক্রয় করতে মানুষকে উৎসাহিত করতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
তারা আরও বলেন, সরকার এবং তামাক কোম্পানির লক্ষ্য সম্পূর্ণ বিপরীতমূখী। সরকার ২০৪০ সালে মধ্যেই দেশকে তামাকমুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছে এবং অপর দিকে তামাক কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত তাদের ব্যবসা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশে ধূমপায়ী বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছে।সরকারের উদ্দেশ্য সংবিধানের দায়বদ্ধতা, জনস্বাস্থ্য রক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যয় কমানো।আর তামাক কোম্পানির লক্ষ্য মুনাফা অর্জন।
রাজস্ব নিয়ে তামাক কোম্পানির মিথ নিয়ে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের অতি প্রচলিত একটি মিথ হলো তামাক কোম্পানিগুলো বিশেষ করে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি সরকারকে সর্বোচ্চ পরিমাণ ট্যাক্স দেয়। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তামাক খাত থেকে অর্জিত রাজস্বের সিংহভাগ (২২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা) আসে এই কোম্পানি থেকে।কিন্তু এই বিশাল অংকের রাজস্বের ৯৪ শতাংশেরও অধিক আসে জনগণের ভ্যাট থেকে।ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি দেয় মাত্র ৮১৬ কোটি টাকা।সুতরাং বহুদিন ধরে ভোক্তাদের প্রদত্ত ভ্যাটকেও তামাক কোম্পানি তাদের প্রদত্ত রাজস্ব বলে চালিয়ে আসছে। এছাড়া ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর তামাক খাত থেকে সরকারের উপার্জিত রাজস্বের বিপরীতে তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা বাবদ সরকারের ব্যয় হয় ৭.৫ হাজার কোটি টাকার অধিক।
তারা আরও বলেন আগামী অর্থবছর থেকে তামাকজাত পণ্যের মূল্য ও সুনির্দিষ্ট কর আরোপ হলে সরকার অতিরিক্ত ৯ হাজার কোটি টাকার অধিক রাজস্ব আয় করতে সক্ষম হবে। পণ্যের উপর সুনির্দিষ্ট করারোপের বিধান বাংলাদেশে নুতন কিছু নয়। ব্যাগেজ বিধিমালা- ২০১৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের বাইরে থেকে বেশ কয়েকটি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্য ব্যাতিরেকে শুধুমাত্র পরিমানের উপর সুনির্দিষ্ট কর আরোপের বিধান রয়েছে। মোবাইল সিম এর ক্ষেত্রেও এ বিধান বিদ্যমান।
সিগারেটের প্যাকেটে মুদ্রিত খুচরা মূল্যের পূর্বে বা পরে সর্বোচ্চ/সর্বনিম্ন শব্দটি উল্লেখিত না থাকায় এবং খুচরা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের সুযোগ নিয়ে স্থানভেদে পণ্যের মোড়কে মুদ্রিত মূল্যের থেকে অধিক মূল্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় হচ্ছে। এই অতিরিক্ত মূল্যের উপর কোনো প্রকার কর ধার্য না হওয়ায় কারণে সরকার প্রতিবছর প্রায় ৫০০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে বিশেষ উল্লেখ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর সুনির্দিষ্ট কর কাঠামো প্রণয়ন, তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ও শক্তিশালী জাতীয় করনীতি প্রণয়ন, তামাকের ওপরে নির্ভরশীলতা কমিয়ে কর আদায়ের অন্যান্য শক্তিশালী মাধ্যম খুজে বের করা, মূল্যস্তর এর সংখ্যা ৪টি থেকে কমিয়ে ২টি করা, খুচরা শলাকা বিক্রয় নিষিদ্ধকরণ, কর আদায় ব্যবস্থা আধুনিকায়ন এবং সকল প্রকার ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্য, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমুহকে রেজিস্ট্রেশন ও করের আওতায় আসার সুপারিশ করা হয়।