বর্তমানে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির কারণে জনজীবনে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এ ভয়াবহ বন্যার পেছনে বাংলাদেশসহ ভারতের আসাম, মেঘালয়, চেরাপুঞ্জির অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত যেমন দায়ী তেমনি আমাদের প্রাকৃতিক হাওর-বাঁওড়, নদ-নদীসহ বিভিন্ন জলাশয়-জলাভূমির অবাধে ধ্বংস করে ফেলার দায়কেও অস্বীকার করা যায় না। আইনের শাসনের অভাবে সারাদেশেই নদীদখল, জলাশয়-জলাভূমি ভরাট চলছে নির্বিচারে। একইসাথে আমাদের নদীগুলোর নাব্যতা সংকটের কারণে নদীগুলোর পানিধারণ ক্ষমতাও কমেছে মারাত্মকভাবে। দেশ এবং জনগণকে রক্ষায় আমাদের হাওর-বাঁওর, নদী-খাল, জলাশয়-জলাভূমি প্রভৃতি প্রাকৃতিক জল ধারণ এলাকা সংরক্ষণের কোন বিকল্প নেই। আজ দুপুর ৩.৩০ আয়োজিত ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের উদ্যোগে আয়োজিত “বন্যা পরিস্থিতি: নদী খাল ও জলাধার সংরক্ষণের গুরুত্ব ও করণীয়” শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় বক্তারা এ অভিমত প্রদান করেন। ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর প্রজেক্ট ম্যানেজার নাঈমা আকতার এর সঞ্চালনায় লাইভ টকশোতে বক্তব্য রাখেন নগর গবেষণা কেন্দ্রের সেক্রেটারি সালমা এ সাফি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এর প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো: সিরাজুল ইসলাম, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এর প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ হাসেম এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর পরিচালক গাউস পিয়ারী।
মাকসুদ হাসেম বলেন, পরিমিত বৃষ্টি কৃষক ও পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যার তীব্রতা বেড়ে গেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের ভূমি ব্যবহারও পরিবর্তিত হয়ে গেছে। প্লাবনভূমিতে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন না হলে বন্যার ভয়াবহতা এতাটা হতো না। কোন ধরণের উন্নয়ন কার্যক্রমেই যেন প্লাবনভূমি নষ্ট না হয়, সে বিষয়টি নীতিমালার মাধ্যমে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কৃত্রিম ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমাদের বন্যা-জলাবদ্ধতা ও জনদূর্ভোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়।
মো: সিরাজুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, ডিসেম্বর ২০২০ এ খালের দায়িত্ব পাওয়ার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন খাল পুনরুদ্ধারে কাজ করছে। জিরানি, মান্ডা, শ্যামপুর, কালুনগর- এ চারটি খাল পুনরুদ্ধারে কাজ করা হয়েছে। সুয়ারেজের লাইন খালে দেয়ার কারণে খালগুলো দিয়ে পানি নিষ্কাশিত হতো না। এ খালগুলো থেকে প্রায় দশ হাজার মেট্রিক টন আবর্জনা অপসারণ করা হয়েছে। রাজউকের সাথে সমন্বয় করে খালে যেন সুয়ারেজ লাইন দেয়া না হয় এবং সেপটিক ট্যাঙ্ক এর ব্যবস্থা করার আলোচনা চলমান আছে। খাল পুনরুদ্ধার করে নগরবাসীর জন্য গণপরিসর তৈরির লক্ষ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কাজ করছে।
সালমা এ সাফি তার আলোচনায় বলেন, আমাদের একটি ন্যাশনাল ফিজিক্যাল প্ল্যান প্রয়োজন। যেকোন প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্বে তার ইমপ্যাক্ট স্টাডি করা অপরিহার্য। জনগণকে প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন কারণ তারাই তাদের এলাকা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ভালো জানে। আমাদের গবেষণানির্ভর কাজে গুরুত্ব দিতে হবে এবং সুস্পষ্ট নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধুমাত্র প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে পর্যাপ্ত গবেষণা ও ইমপ্যাক্ট স্টাডির মাধ্যমে পদক্ষেপ নেয়া হলে অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবকে অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ভূমির ব্যবহার পরিবর্তন হওয়ার সাথে নি¤œাঞ্চল ও কৃষিজমিতে বসতবাড়ি, সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো গড়ে উঠছে। সড়কগুলো আমাদের বন্যার পানি সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় অনেকেই সাময়িক আর্থিকভাবে উপকৃত হন কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে জনজীবন ও প্রকৃতির ক্ষতিসাধিত হয়। আমাদের নগর এলাকা অনেক বেশি কনক্রিটে ছেয়ে গেছে। এ থেকে সরে এসে সবুজ পরিসর গড়ে তোলা প্রয়োজন।
গাউস পিয়ারী বলেন, শহরে বসবাসরত মানুষের নিত্যদিনের কিছু অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস জলাবদ্ধতা তৈরি করে। বিশেষত একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক, পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, মোড়ক যত্রতত্র ফেলা জলাবদ্ধতার একটি বড় কারণ। শৈশব থেকে সুঅভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিদ্যালয়গুলোর একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। আইনের শাসনের অভাবে সারাদেশেই নদী দখল, জলাশয়-জলাভূমি ভরাট চলছে। নদীগুলোর নাব্যতা সংকটের কারণে নদীগুলোর পানিধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। আইনের প্রয়োগরে মাধ্যমে আমাদের মৃতপ্রায় নদী-খাল-জলাধার পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হতে হবে।