তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘণ করে ৩০টির অধিক উপায়ে তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে দেশীয় ও বহুজাতিক বিভিন্ন তামাক কোম্পানি। আইনের দুর্বল প্রয়োগ তামাক কোম্পানিগুলোকে আইন লঙ্ঘণে আরো উৎসাহিত করছে। ফলে আগ্রাসী প্রচার-প্রচারণায় শিশু-কিশোর ও তরুণরা ধূমপানে আকৃষ্ট হচ্ছে এবং তামাকজনিত ক্ষয়-ক্ষতি ও মৃত্যুহার বাড়ছে। যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করছে। আগামী প্রজন্মের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ও সরকার প্রধানের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আইন লংঘনকারী তামাক কোম্পানিগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৩ অক্টোবর ২০২১ বেলা ১১:০০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে “তামাক নিয়ন্ত্রন আইন লঙ্ঘনের বর্তমান চিত্র এবং করণীয়” শীর্ষক গণমাধ্যমের সাথে একটি মতবিনিময় সভায় বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট, এইড ফাউন্ডেশন, গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি, জাতীয় যক্ষা নিরোধ সমিতি (নাটাব), টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি) এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট সম্মিলিতভাবে সভাটি আয়োজন করে।
বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট এর ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী হেলাল আহমেদ এর সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন এইড ফাউন্ডেশনের তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প পরিচালক সাগুফতা সুলতানা, নাটাব এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক একেএম খলিল উল্লাহ, টিসিআরসি’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা জামান লিজা। সভায় মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি’র নির্বাহী পরিচালক একেএম মাকসুদ এবং সভাটি সঞ্চালনা করেন ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট’র কর্মসূচি ব্যবস্থাপক সৈয়দা অনন্যা রহমান।
প্রবন্ধে একেএম মাকসুদ বলেন, বর্তমান সময়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘণ করে সর্বাধিক বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা চালাচ্ছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি। পাশাপাশি অন্যান্য তামাক কোম্পানিগুলোও প্রায় বিনা বাঁধায় তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাংলা, নাটাব, টিসিআরসি, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট পরিচালিত ভিন্ন ভিন্ন গবেষণায় তামাকজাত দ্রব্যের মোট ৩১টি বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা কৌশল চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম বিক্রয় কেন্দ্রে তামাক কোম্পানির ব্রান্ডিং রং ও লোগো সম্বলিত সোকেস, খালি প্যাকেট সাজানো, ষ্টিকার, পোস্টার, ফ্লাইয়ার, রেস্টুরেন্টে ‘স্মোকিং জোন’ তৈরী, নাটক, সিনেমায় ধূমপানের দৃশ্য প্রচার, জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে প্রচারণা, ভ্রাম্যমাণ ভ্যান এবং বিক্রয় কর্মী ও ক্রেতাদেরকে বিভিন্ন উপহার প্রদান ইত্যাদি। ধোঁয়াবিহীন তামাক কোম্পানিগুলোও প্রচারনার ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। দীর্ঘ সময় ধরে নানা কৌশলে মানুষকে জর্দা, গুল, খৈনী ব্যবহারে উৎসাহিত করছে এ কোম্পানিগুলো। এক্ষেত্রে ধর্ম ও সংস্কৃতির অপব্যবহার, নামে-মোড়কে সাধু/উত্তম পুরুষের নাম ও ছবি ব্যবহার, অবৈধভাবে বিএসটিআই এর লোগো ব্যবহার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
একেএম খলিল উল্লাহ বলেন, তামাক বিরোধী আন্দোলনে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশ ও মানুষের কল্যাণে সাংবাদিকরা তাদের লেখনী শক্তির মাধ্যমে এ আন্দোলনকে আরো গতিশীল করতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তামাক কোম্পানীগুলোর আগ্রাসী প্রচারণা ও আইন লংঘনের চিত্রগুলো গণমাধ্যমে আরো অধিক হারে প্রকাশ করা জরুরী।
সাগুফতা সুলতানা বলেন, দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন, বিধিমালা রয়েছে। সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে তামাক বিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তারপরেও তামাক নিয়ন্ত্রণে কাঙ্খিত সাফল্য আসছে না এর অন্যতম প্রধান কারণ, তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার। সরকারকে দ্রুত এ অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। টাস্কফোর্স কমিটিগুলো সক্রিয় করার মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় গুরুত্ব দিয়ে আইন লঙ্ঘণকারী ব্যক্তি ও কোম্পানিগুলোকে জরিমানার পাশাপাশি জেল প্রদান জরুরী।
গাউস পিয়ারী বলেন, তামাকের বিজ্ঞাপন নয়, স্বাস্থ্যকর জীবন-যাপনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর প্রচার বাড়াতে হবে। তরুণদের তামাক বিমুখ করতে হলে তামাকের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা সম্পূর্ণরুপে বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে তামাক নিয়ন্ত্রনে কর্মরত সংস্থাগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সরকারের কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করা জরুরী। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তামাক নিয়ন্ত্রণ গাইডলাইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে ‘লাইসেন্সিং ব্যবস্থা’ প্রবর্তনে জোরালোভাবে কাজ করতে হবে।
হেলাল আহমেদ বলেন, মানুষের কাছে তামাক পণ্য সহজে পৌছে দিতে বিভিন্ন তামাক কোম্পানি স্কুল-কলেজ, মার্কেট ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হাজার হাজার ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন ও এসকল স্থানে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। আইন অনুসারে এসকল স্থান ধূমপানমুক্ত কিন্ত আশেপাশে তামাকের দোকান আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যকে ব্যহত করছে। আইন লঙ্ঘণে প্রকৃত অপরাধীরা পিছনে রয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকার যথেষ্ট আন্তরিক। সরকার প্রধানের কমিটমেন্ট রাখতে হলে সকলকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
ফারহানা জামান লিজা বলেন, তামাক পাতা দ্বারা ভ্যাকসিন আবিস্কারের গল্প শুনিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে তামাক কোম্পানিগুলো। সিগারেট, বিড়িতে বিভিন্ন ফ্লেভার ব্যবহার, আকর্ষণীয় মোড়ক ও চটকদারী বার্তা এবং জর্দা গুলের প্রচারণায় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাবকে কাজে লাগাচ্ছে কোম্পানিগুলো। তামাকজাত পণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর মুদ্রণের বিধি সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে না। দেশে ই-সিগারেট জরুরীভাবে বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বাস্তবায়ন মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন সম্প্রীতি সোসাইটি’র কর্মকর্তা তুষার চন্দন, ঢাকা আহছানিয়া মিশনের প্রোগ্রাম অফিসার শারমিন আক্তার, ডরপ্ এর মিডিয়া অফিসার আরিফ বিল্লাহ, ইটিভি-বাংলা’র প্রতিনিধি শেখ নূর ইসলাম, সাংবাদিক কোহিনূর তাজ পারভীন, ‘হিল’ এর প্রতিষ্ঠাতা জেবুন্নেসা চৌধুরী প্রমুখ। এছাড়াও অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো-ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, উবিনীগ, ডাস, মৃত্তিকা, কেএইচআরডিএস, এএসডাব্লিউএস, শীল্ড, নবনীতা মহিলা কল্যাণ সমিতি ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিবৃন্দ সভায় উপস্থিত ছিলেন।