তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা জরুরি ; এমপাওয়ার বিষয়ক সম্মেলনের দাবি (Conference on WHO MPOWER policy implementation)
তামাক উন্নয়নে অন্যতম প্রধান অন্তরায়। হৃদরোগ, স্ট্রোক, বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার, ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগ (সিওপিডি, এজমা), ডায়বেটিসসহ প্রাণঘাতী বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের অন্যতম প্রধান কারণ তামাক। বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৫৯% এসব অসংক্রামক রোগে মারা যায়। প্রায় ৪০% অসংক্রামক রোগের জন্য দায়ী ধূমপান ও তামাক সেবন। তামাকজনিত কারণে বছরে প্রায় ১ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। তাই তামাক নিয়ন্ত্রণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক। ১৬ মে ২০১৭ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে দিনব্যাপী “
(Conference on WHO MPOWER policy implementation)”-এ দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞবৃন্দ উপরোক্ত আহবান জানান।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়-এর নবগঠিত স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ঘঈউঈ-উএঐঝ), স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট (ঐঊট) ও জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (ঘঞঈঈ), তামাক বিরোধী বেসরকারি সংগঠনগুলোর সম্মিলিত মঞ্চ বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর সম্মিলিত উদ্যোগে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সকাল উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের হুইপ শাহাব উদ্দিন এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন এড. ফজিলাতুন নেসা বাপ্পী এমপি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন এন্ড হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আবদুল মালিক এবং বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের সমন্বয়কারী সাইফুদ্দিন আহমেদ। সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় যক্ষা নিরোধ সমিতি (নাটাব) সভাপতি বিশিষ্ট রাজনীতিক মোজাফফর হোসেন পল্টু। উদ্বোধনী অধিবেশন সঞ্চালন করেন ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর কর্মসূচি ব্যবস্থাপক সৈয়দা অনন্যা রহমান।
জাতীয় অধ্যাপক ব্রি. (অব.) ডা. আবুল মালিক বলেন, অসংক্রামক রোগের অন্যতম প্রধান কারণ ধূমপান ও তামাক সেবন। এটি মানবদেহে নানা ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়বেটিসের মত মরণব্যাধি সৃষ্টি করছে। তাই তামাক নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্ব দিতে হবে। এড. ফজিলাতুন নেসা বাপ্পী এমপি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। সে লক্ষ্যে সরকার কাজ শুরু করবে। সরকারের কাজে সহযোগিতার জন্য গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
মোজাফফর হোসেন পল্টু বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো বিভিন্নরকম অপতৎপরতার মাধ্যমে সরকারের নীতি ও আইন বাস্তায়ন কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি করছে। তামাক কোম্পানিগুলো যেন আইন লঙ্ঘণ করে কোন প্রচারণা করতে না পারে, সেজন্য তাদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
হুইপ মো. শাহাব উদ্দিন এমপি বলেন, বাংলাদেশে সবচাইতে কম মূল্যে তামাকজাত দ্রব্য কিনতে পাওয়া যায়। ফলে দরিদ্রদের মধ্যে তামাকের ব্যবহার বেশি। এজন্য তামাকের উপর কর বাড়াতে হবে। আসন্ন বাজেট অধিবেশনে যেন তামাকের কর যেন বাড়ানো হয়, সেজন্য সংসদ সদস্যদের পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রীকে অনুরোধ করা হবে। সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, তামাক খাতে যে ১% স্বাস্থ্যকর রয়েছে, সে অর্থ তামাক নিয়ন্ত্রণসহ অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগানো দরকার। এজন্য দ্রুত স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থাপনা নীতি পাস করা জরুরি।
বিকাল সাড়ে ৪টায় সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ এমপি। এতে বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট উপদেষ্টা আবু নাসের খান। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট সমন্বয়কারী সাইফুদ্দিন আহমেদ। ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর কর্মসূচি ব্যবস্থাপক সৈয়দা অনন্যা রহমান । সমাপনী অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ও সম্মেলনের ঘোষণা পাঠ করেন বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট মুখপাত্র আমিনুল ইসলাম সুজন।
প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা এমপি বলেন, তামাকজনিত মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে সরকার ২০১৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করেছে। ২০১৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধিমালা পাস করেছে। অর্থমন্ত্রী তামাকের কর বৃদ্ধির কথা বলেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। রংপুরে তামাক চাষ প্রবণ এলাকা। তামাক চাষের কারণে খাদ্য ও শস্য উৎপাদন ব্যহত হয়। ফলে রংপুরে এক সময় মঙ্গাসহ নানা সঙ্কট লক্ষ্য করা যেত। এখন তামাক চাষ কমে আসছে বলে প্রতীয়মান। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে তামাক নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছি। আবু নাসের খান বলেন, বাংলাদেশে গত ১০ বছরে যত আইন হয়েছে, বাস্তবায়নের দিক থেকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অন্যতম। ধূর্ত তামাক কোম্পানির প্রতারণামূলক কার্যক্রমের পরও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন খুবই ভাল হচ্ছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে বেসরকারি সংগঠনগুলো সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) চুড়ান্ত করে। বাংলাদেশ ২০০৪ সালে এ চুক্তি স্বাক্ষর ও ২০০৪ সালে অনুস্বাক্ষর করে। এফসিটিসির আলোকে বাংলাদেশ ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ পাস করে, যা ২০১৩ সালে অধিকতর শক্তিশালী করে সংশোধন করে।
এফসিটিসির কার্যকর বাস্তবায়নে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৮ সালে এমপাওয়ার (গচঙডঊজ ঢ়ড়ষরপু) নীতি গ্রহণ করে। এফসিটিসি, এমপাওয়ার, বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ইত্যাদির সমন্বয়ে এ সম্মেলনে তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক বিভিন্ন সেশন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে টেকসই উন্নয়ন ও তামাক নিয়ন্ত্রণ এবং তামাকজাত দ্রব্যের কর বৃদ্ধি বিষয়ক দুটি প্ল্যানারি সেশন এবং ধূমপানমুক্ত স্থান, তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন-প্রণোদনা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধকরণ ও তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ সতর্কবাণীর বাস্তবায়ন ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা ও করণীয় নির্ধারণে তিনটি বিষয়ে ছয়টি সেশন অনুষ্ঠিত হয়।
দিনব্যাপী সম্মেলনে ঢাকার বাইরের ৯০টি সংগঠনসহ ১৩০টি সংগঠনের প্রতিনিধি, ৫০জন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, একাধিক নীতি নির্ধারকসহ প্রায় ২০০ জন মানুষ অংশ নেন।