তামাক কোম্পানিগুলো ব্যবসার প্রসারের জন্য নানাভাবে নীতি প্রণয়ন প্রভাব বিস্তার করছে, কোম্পানিগুলোর এ প্রভাব প্রতিহত করতে সরকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি এফসিটিসি ৫.৩ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। দেশে মোট মৃত্যুর ১৪.৬% এর জন্যই দায়ী ধূমপান ও তামাক সেবন। তাই তামাক কোম্পানিকে সহযোগিতা বা তামাক কোম্পানির কার্যক্রমে অংশগ্রহণ কিংবা তামাক কোম্পানির প্রতারণা প্রতিরোধে নিস্ক্রিয় থাকা প্রকারান্তরে মৃত্যুকেই উৎসাহিত করার সামিল।
০৩ এপ্রিল, ২০১৭ সকালে ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্ট কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় দেশের বিশিষ্টজনেরা উপরোক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন। ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট, কনজিউমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এবং ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি) এর যৌথ উদ্যোগে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। দুর্নিতী দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ক্যাব সভাপতি ড. গোলাম রহমান এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ সভাপতি ডা. এস কাদের পাটোয়ারী, বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. ওবায়দুল্লাহ বাকী, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন দি ইউনিয়নের কারিগরি পরামর্শক এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারী প্রমুখ। ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক সৈয়দা অনন্যা রহমানের সঞ্চালনায় সভায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের মুখপত্র সমস্বর নির্বাহী সম্পাদক আমিনুল ইসলাম সুজন।
প্রবন্ধে আমিনুল ইসলাম সুজন বলেন, ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলো প্রতারণামূলক বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করছে। ইতোপূর্বে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করেছিল প্রাণঘাতি পণ্যের বহুজাতিক ব্যবসায়ী ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি)। এছাড়া বিএটিবির কর বিষয়ক জরিমানা মওকূপ করতে ব্রিটিশ হাইকমিশনের চিঠি প্রদান করার মত নেতিবাচক দৃষ্টান্তও রয়েছে। জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তামাক কোম্পানিগুলোর এসব প্রতারণা বন্ধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল –এফসিটিসিতে, বিশেষ করে এর আর্টিকেল ৫.৩-এ নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এফসিটিসিতে স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে এ চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
গোলাম রহমান বলেন, শক্তিশালী আইন ও তামাকের উচ্চ মূল্যের কারণে উন্নত দেশগুলোতে তামাক ব্যবহার ও তামাক চাষ কমছে, কিন্তু বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তামাক ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশে তামাকের দাম খুব কম। আইনের বাস্তবায়নও দুর্বল। তাই তামাকের ব্যবহার বাড়ছে। এছাড়া তামাক কোম্পানির নানা কার্যক্রমে তামাক চাষও বাড়ছে। তামাক চাষের ফলে নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তামাক চাষের পরিবর্তে লাভজনক বিকল্প খাদ্যশস্য উৎপাদনে কৃষকদের সহযোগিতা করা প্রয়োজন।
অধ্যাপক ডা. ওবায়দুল্লাহ বাকী বলেন, বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগের প্রকোপ কমিয়ে আনতে অধ্যাপক ডা. সৈয়দ ফজলুল হকের নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে ক্যান্সার সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তামাক যেহেতু ক্যান্সারের প্রধান কারণ, তাই প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই তামাক নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় রয়েছে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি। তামাকের উপর কর বৃদ্ধি বিষয়ে বর্তমানে আমরা আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির সহায়তায় কাজ করছি। আমরা আশাবাদী, সরকার তামাকের কর যৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি করবে।
তামাক নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন বিষয়ে ধূর্ত তামাক কোম্পানির প্রভাব বিস্তারের উদাহরণ তুলে ধরে এড. সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ ও বিএসটিআই’র আইন অনুযায়ী যে কোন দ্রব্যের মোড়কে উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ প্রদান করা বাধ্যতামূলক। সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে না থাকায় ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদানের উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ প্রদান না করায় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিকার অধিদপ্তরে অভিযোগ দায়ের করা হয় প্রায় দু’বছর আগে, যার এখনো চুড়ান্ত সমাপ্তি হয়নি। এখনও তামাকের মোড়কে উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ দেয়া হচ্ছে না। এতে শুধু দুটি আইন লঙ্ঘিতই হচ্ছে না, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ডা. এস কাদের পাটোয়ারী বলেন, যেহেতু তরুণদের নেশার দিকে ধাবিত করার মাধ্যমে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় তামাক ও ধূমপান, তাই ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ছাত্র-ছাত্রীদের সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্ব দিয়ে টোব্যাকো কন্ট্রোল ও রিসার্চ সেল গঠন করেছে। আমরা চাই, ছাত্র-ছাত্রীদের নেশা থেকে দূরে রাখতে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় হওয়া জরুরি। গাউস পিয়ারী এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩ বাস্তবায়নে সরকারি নির্দেশনা প্রদান করতে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল-এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন তামাক বিরোধী জোট (তাবিনাজ) এর প্রতিনিধি রোকেয়া বেগম, ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবিয়িং এর কর্মকর্তা মাছুম বিল্লাহ, একলাব প্রতিনিধি আবদুল কাদের, ক্যাব এর সহ-সভাপতি নাজির হোসেন।
অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, ধূমপানের কারণে ফুসফুস ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ক্যান্সার হয়। বর্তমান সময় অনুযায়ী ক্যান্সার চিকিৎসা দিতে গেলে ১৬০টি ক্যান্সার হাসপাতাল দরকার। এত অর্থ যোগান দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ক্যান্সার যেন না হয়, সেজন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আর ক্যান্সারের প্রধান কারণ হিসাবে তামাক নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর হতে হবে।