পার্ক, খেলার মাঠ এবং উন্মুক্ত গণপরিসর নগরজীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে একটি শহরে প্রতি একজন নাগরিকের জন্য ৯ বর্গমিটার সবুজ পরিসর প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকা শহরে প্রতি একজন নাগরিকের জন্য মাত্র ০.০৫২ বর্গমিটার সবুজ পরিসর রয়েছে। যা বসযোগ্য নগর এবং নগরবাসীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। পার্ক ও খেলার মাঠ নগরবাসীর সামাজিকীকরণ, বিনোদন, খেলাধুলা, মানসিক প্রশান্তি এবং শরীরচর্চার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। পাশপাশি উন্মুক্ত এ পরিসরগুলো নগরবাসীকে পরিবেশগত সুবিধা, সামাজিক ও ব্যক্তিগত কল্যাণ এবং সক্রিয় বিনোদনের সুযোগ করে দেয়। এ কারণে প্রতিটি এলাকায় পার্ক ও খেলার মাঠের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ সকলের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ২৯ অক্টোবর ২০১৬, সকাল ১১.০০ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘ঢাকার পার্ক ও খেলার মাঠ’ শীর্ষক প্রকাশনার উন্মোচন এবং আলোচনা সভায় বক্তারা এ মত ব্যক্ত করেন।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর সহকারি এডভোকেসি কর্মকর্তা নাঈমা আকতার। তিনি বলেন, গবেষণা থেকে পার্ক ও খেলার মাঠের বিভিন্ন সমস্যা উঠে এসেছে কিন্তু এটিও প্রতীয়মান হয়েছে যে, পার্ক ও খেলার মাঠগুলোর বর্তমান অবস্থা উন্নয়ন হলে তারা আরো বেশি বেশি পার্ক ও খেলার মাঠে যেতে আগ্রহী। ১২ টি পার্ক ও খেলার মাঠে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় যে ৩৫% শতাংশ ব্যবহারকারী মূলত হাঁটার উদ্দেশ্যে এবং ২৭% সামাজিকীকরণের জন্য মাঠে আসেন। গবেষণা থেকে আরো দেখা যায়,৬টি পার্ক ও খেলার মাঠে ঝুঁকিপূর্ণ আবর্জনা দেখা যায়। ৪টিতে আবর্জনা পাত্র থাকলেও তা যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ হয়না।
হেলথব্রিজ-কানাডা এর আঞ্চলিক পরিচালক, দেবরা ইফরইমসন বলেন, সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পার্ক ও খেলার মাঠ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধরা এ স্থানগুলোকেই অবসর যাপনের একটি স্থান হিসেবে নির্বাচন করেন। প্রবেশগম্যতার অভাবে আমাদের সমাজের অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পার্ক ও খেলার মাঠে যেতে পারেন না। এমনকি নিরাপত্তা, খেলাধুলার উপকরণের অভাব নারী এবং শিশুদের পার্ক ও খেলার মাঠে যেতে নিরুৎসাহিত করে। এ অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণ প্রয়োজন।
আদিল মোহাম্মদ খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট প্ল্যানার্স, বলেন, পার্ক ও খেলার মাঠ কেবলমাত্র ঢাকা শহরের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের প্রতিটি শহরের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ না হওয়ার কারণে দখলদারিত্ব বা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডের কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। বর্তমান যুগের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে প্রতিটি এলাকায় পার্ক ও খেলার মাঠ গড়ে তোলা প্রয়োজন এবং এর রক্ষণাবেক্ষণে স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্তা নিশ্চিত করতে হবে। মাঠ ও পার্কে সিটিজেন চার্টার সম্বলিত সাইন্ডবোর্ড স্থাপনের মাধ্যমে স্থানীয় এলাকাবাসীর সেবা নিশ্চিত করা।
স্থপতি এবং পরিকল্পনাবিদ, সালমা আওয়াল শফি, বলেন, পার্ক ও খেলার মাঠে নানা রকম অপরাধ সংঘটিত হওয়ায় নারীদের পার্কে ও খেলার মাঠে যেতে নিরুৎসাহিত করে। নগর পরিকল্পনায় পার্ক ও খেলার মাঠকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। এগুলো তরুণ সমাজকে অপরাধ প্রবণতা থেকে দূরে রাখতে এবং মানসিক ও শারীরিক সুষ্ঠু বিকাশে সহায়তা করে। সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে একত্রে পার্ক ও খেলার মাঠের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সুপারেন্টেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার, তারিক বিন ইউসুফ, বলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে পার্ক ও খেলার মাঠের উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। শ্যামলী পার্কে বিভিন্ন পরিবর্তন এসেছে। উত্তরা ৭ নং সেক্টর পার্কটিকে নকশা করে সকলের জন্য ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী বছরের মার্চ মাসের মধ্যে আমরা জনগণকে কিছু সুন্দর পার্ক ও খেলার মাঠ উপহার দিতে পারব। শুধু উত্তর সিটি কর্পোরেশন নয়, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনও এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্যোগী। দুই মেয়র তাদের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী সবুজ ঢাকা গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে পার্ক ও খেলার মাঠগুলোর উন্নয়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন।
গাউস পিয়ারী, পরিচালক, ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট, বলেন, যে সকল পার্ক ও খেলার মাঠ দখল হয়ে গেছে, সেগুলো দখলমুক্ত করার রক্ষ্যে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি এগুলোতে নারী-পুরুষ-প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ সকলের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। আগামী প্রজন্মকে যদি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গড়ে ওঠা থেকে প্রতিহত করতে হয়, তবে তাদের উন্মুক্ত এবং গণপরিসরে বিচরণের সুযোগ করে দিতে হবে।
আলোচনা সভাটি সঞ্চালনা করেন মারুফ হোসেন, প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট। আলোচনা সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন, আসিনুর রসুল, সদস্য সচিব, উন্নয়ন ধারা ট্রাস্ট; আমির হাসান, সভাপতি, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চ; ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর কর্মকর্তাবৃন্দসহ আরো অনেকে।