রেলওয়ের উন্নয়নে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন এবং রেল বাজেট বৃদ্ধি পেলেও বাংলাদেশ রেলওয়ে যাত্রী সাধারণকে কাঙ্খিত সেবা প্রদান করতে পারছে না। ২০১২ সালে রেল পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে যাত্রী সেবা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেলের ভাড়া বাড়ানো হলেও যাত্রী সেবা এবং আয় বাড়েনি। বরং যাত্রী ও পণ্য পরিবহন উভয়ই হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে যাত্রী সেবা বৃদ্ধির পরিকল্পনা না করে বিদেশী সংস্থার পরামর্শে ভাড়া বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। ট্রেন প্রতি আয় শুধু যাত্রীর কাছ থেকে পাওয়া ভাড়ার ওপর নির্ভর করে না, কোচের সংখ্যা, অকুপেন্সি এবং ট্রেনের টার্ন অ্যারাউন্ড এর ওপরও ট্রেন প্রতি আয় নির্ভর করে। অতত্রব ট্রেন পরিচালনায় এই বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করলে ট্রেন প্রতি ব্যয় হ্রাস করে রেলকে স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। আজ ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ১১.০০ টায় পবা কার্যালয়ে পরিবেশ বাচাঁও আন্দোলন (পবা) ও ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের যৌথ উদ্যোগে সাশ্রয়ী ও নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে “রেলের ভাড়া: প্রাসঙ্গিক ভাবনা” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ আহ্বান জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাষ্ট এর প্রকল্প কর্মকর্তা মোঃ আতিকুর রহমান প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলেন, রাষ্ট্রী সেবা খাত হিসেবে রেলের পরিচালন ব্যবস্থা সঠিকভাগে পরিচালনা না করায় যাত্রী সেবা যেমন কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না, তেমনি রেলের পরিচালনা ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। রেললাইন সংস্কার, নতুন রেলপথ নির্মাণ ও অবকাঠামো তৈরির প্রকল্প গ্রহন করা হলেও ট্রেনের সময়ানুবর্তিতার কোনো উন্নয়ন হয়নি। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে আন্তঃনগর ট্রেন ৮৯%, মেইল/এক্সপ্রেস ট্রেন ৭৪% এবং লোকাল ট্রেন ৯৪% মেনে চলতে পেরেছে। রেললাইন খারাপ থাকায় পূর্বাঞ্চলে ৩১ টি স্থানে লোকোমোটিভকে নির্ধারিত গতির চেয়ে ধীর গতিতে চলতে হয়। এবং কি লোকোমোটিভ যা আছে তা ব্যবহার করতে পারছি না। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে পূর্বাঞ্চলে ১৫৪ টি লোকোমোটিভ ব্যবহারের হার ছিল ৬৮.২০ শতাংশ এবং পশ্চিমাঞ্চলে মিটারগেজ ৮০% ও ব্রডগেজ ৭৪.০৬ %।
রেলওয়ের সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিকায়নের অভাবে পূর্বাঞ্চলে গত বছর অক্টেবর মাসে ৮৯ টি ফেইলরের ঘটনা ঘটেছে এবং সময় ব্যয় হয়েছে ৬/২৬ ঘন্টা। ভাড়াবৃদ্ধি না করেও যাত্রী সেবা লাভজনক করা সম্ভব। ট্রেন প্রতি কোচের সংখ্যা বৃদ্ধি করে আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব। কোচের সংখ্যা বাড়লে ট্রেন থেকে আয় বাড়ে, কিন্তু খরচ যেমন: রেললাইন, ইঞ্জিন, গার্ড, চালক, প্লাটফর্ম ইত্যাদি সমানুপাতে বাড়াতে হয় না। পাশপাশি ট্রেনের টার্ন অ্যারাউন্ড বাড়িয়ে ট্রেনের ট্রিপ বৃদ্ধি করা সম্ভব। যা ট্রেনের আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে স্টেশন ও লোকবল বেশি থাকা স্বত্ত্বেও ট্রেন পরিচালনা করতে ১০০ টাকা আয় করতে খরচ করতে হতো ৯৫ ও ৯৪ টাকা। অতীতের চেয়ে বর্তমানে স্টেশন ও লোকবল হ্রাস পেলেও পরিচালনা ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২০০.২ শতাংশে। ভাড়া বাড়ানো কোন সমাধান নয়। হিসেব নিকেশে কিছুটা আয় বৃদ্ধি হলেও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয় সাধন করতে না পারলে এর কোন সুফলই জনগণ পাবে না।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ট্রেন প্রতি আয় কোচের সিটের অকুপেন্সির উপরও নির্ভর করে। কেননা একটি সিট খালি যাওয়া মানে যাত্রী থেকে আয়ের সুযোগ নষ্ট হওয়া। বাংলাদেশ রেলওয়ের নভম্বর মাসে পূর্বাঞ্চরে প্রথম শ্রেণীর সিটের অকুপেন্সি ছিল ৬২ শতাংশ এবং এসি সিটের অকুপেন্সি ছিল ৮৪ শতাংশ। ফলে রেল কাঙ্খিত আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া মৌসুম অনুযায়ী বিভিন্ন রুটে ট্রেনের চাহিদা অনুযায়ী কোচের কম্বিনেশন করে ট্রেনের আয় বাড়ানো যায়।
সুষ্ঠু টিকিট ব্যবস্থাপনার অভাবে রেলযাত্রী যেমন টিকিট প্রাপ্তি নিয়ে ভোগান্তিতে পড়ছে, তেমনি রেলওয়ে কাঙ্খিত আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে পর্বাঞ্চলে যাত্রী থেকে আয়ের লক্ষমাত্রা ৩৪ কোটি ৪০ লক্ষ টাকার বিপরীতে আয় করে ৩১ কোটি ৮২ লক্ষ। অথচ নভেম্বরে আয় ছিল ৩২ কোটি ৩৪ লক্ষ। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ ২০ শতাংশ কার্বণ নিঃসরণ কমানোর অঙ্গীকার করেছে এবং তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনায় ২০ শতাংশ রেলের যাত্রী বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। ভাড়া বৃদ্ধি করা হলে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাষ্ট এর পরিচালনক গাউস পিয়ারি বলেন, রেলওয়ের ভূসম্পত্তিসহ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, পণ্য পরিবহনে মনোযোগ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা টাকা, কারখানা আধুনিকায়ন করে লোকোমোটিভ ও কোচ তৈরিতে সক্ষমতা অর্জন এবং পরিচালন ব্যবস্থা যুগোপযোগি করার মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়েকে স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠান হিসেব গড়ে তোলা সম্ভব।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের প্রোগ্রাম কো- অডিনেটর বলেন, বর্তমান ভাড়ায় বেসরকারিতে পরিচালিত ট্রেনসমূহ পরিচালনা ব্যয় কমিয়ে মুনাফা অর্জন করতে পারলেও বাংলাদেশ রেলওয়ে পারছে না। উদাহরণ হিসেবে বলেন, জামালপুর কমিউটার ট্রেন সরকারি পরিচালনায় আয় ছিল ১ কোটি ১৯ লক্ষ এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এখন আয় হয় ৩ কোটি ৮ লক্ষ।
রেলের জায়গা রেলের অধীনে রেখে উৎপাদন/আয় বর্ধনমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা; স্টেশনগুলোর আশেপাশের জায়গা রেলের উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত করে উৎপাদন/আয় বর্ধনমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা; পণ্য পরিবহনে রেলের সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহকে বিশেষ করে মার্কেটিং বিভাগকে সচল করা; পোশাক শিল্প খাতের পণ্য, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পণ্য এবং কৃষিপণ্য রেলের মাধ্যমে পরিবহনে পদক্ষেপ গ্রহণ করা; রেলওয়ে সাথে সমগ্র দেশের বন্দর ও শিল্প কারখানাগুলোর সংযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিকল্পনা গস্খহণ; ডাবল লাইনের কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন; দেশে বিদ্যমান রেলওয়ে কারখানাগুলো সচল করে কোচ তৈরি করে প্রতিটি রেলের ইঞ্জিনের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী কোচের সংখ্যা বৃদ্ধি করে আয় বৃদ্ধিতে প্রকল্প গ্রহণ করা; রেল মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত দপ্তরগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন ও গতিশীল সম্পর্ক তৈরি করা; রেলের গবেষণা সেল তৈরি করা; কমিউটার ট্রেন চালু করা; বিআরটিসি’র সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে বাস ও ট্রাক ব্যবহার করে স্টেশন থেকে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করা।