এক সময় দেশের মানুষ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হতো, কিছু ওষুধ সেবন করালেই তা সেরে যেতো। কিন্তু এখন সংক্রামক নয়, অসংক্রামক রোগেই আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। দীর্ঘজীবন চিকিৎসা দেয়ার পরও তা থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। বরং এই অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়েই বহু মানুষ মারা যাচ্ছে। দীর্ঘ পরিকল্পনা মোতাবেক স্বাস্থ্য খাতকে এগিয়ে না নেয়ায় এমন পরিস্থিতি হচ্ছে। ১লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলামেইল২৪ডটকম ও ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশের (ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট) উদ্যোগে আয়োজিত ‘তামাক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও হেলথ প্রমোশন’ শীর্ষক এক সেমিনারে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ অভিযোগ করেন। কাকরাইলের স্কাউট ভবনে বাংলামেইলের কনফারেন্স রুমে এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিশিষ্ট সমাজকর্মী ফিরোজপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ‘আমরা রোগ প্রতিরোধই চাই। এই টার্গেট যদি আমাদের ঠিক থাকে তাহলে আমাদের মূল বাজাটের অনেক টাকা অবকাঠামো উন্নয়নে চলে যাবে। স্বাস্থ্য সেবা থেকে অনেক টাকা বাঁচবে। এ জন্য হেলথ ফাউন্ডেশন গঠন করা প্রয়োজন। কারণ আমার-আপনার তথা জনস্বাস্থ্য সেব ও শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু রাষ্ট্র সেটা করতে পারেনি। রাষ্ট্র সবার জন্য। তাই তাকে এই চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে। সবাইকে নিয়ে হেলথ ফাউন্ডেশন গঠন করতে হবে। তখন চিকিৎসা বাবদ অনেক টাকা বেঁচে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আজ আমরা যাই খাই সবই ভেজাল-অনিরাপদ। আমরা কিছুই খেতে পারবো না, কোথায় যাবো? ঢাকার সাড়ে ৫ লাখ ভবন বিল্ডিং কোড না মেনে নির্মাণ করা হয়েছে। যেগুলো ভূমিকম্প ঝুঁকিতে। ঢাকায় কালো ধোঁয়ার গাড়ি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু তা চলে যাচ্ছে গ্রামে। ১০ বছর পর এই গ্রামও বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে যাবে। আজ আমরা বোতলের পানি খাই বিশ্বাসে। এগুলোতেও ভেজাল আছে। আজ আমরাই তৈরি করেছি আমাদের দুর্দশা। আমাদের আইন আছে, সব আছে কিন্তু কার্যকর নেই।’
তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘আমি এগুলো নিয়ে সংসদে কথা বলবো। আপনারা একটা খসড়া আইন তৈরি করেন। প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সবার সাথে আমি ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে আইনটি পাসের জন্য কাজ করবো। এটা করা প্রয়োজন। গুলি করলেও আমি পিছনে হটবো না। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়ে দিতে পারলে সহজেই আইনটি পাস হবে বলে আমি মনে করি।’ এ সময় তিনি সংসদের ৯০ ভাগ ব্যবসায়ী উল্লেখ করে বলেন, ‘যারা রাজনীতি করে তারা কেউ রাজনৈতিক নয়।’
পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ এবং ন্যাশনাল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম মনিটরিং সেলের মফিজুল ইসলাম বুলবুল বলেন, ‘আমরা আজ সংক্রামক রোগ থেকে অসংক্রামক রোগের দিকে চলে যাচ্ছি। অসংক্রামক রোগের বড় একটা অসুবিধা হচ্ছে এটা সহজে ভালো হতে চায় না। আর সংক্রামক রোগ কিছু ওষুধ খেলেই ভালো হয়ে যায়। তাহলে আমরা কোথায় যাচ্ছি? বাইরে গেলে বায়ু দূষণ, আর শাকসবজি খেলে ফরমালিন। তাই প্রয়োজন কঠোর আইন।’
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে এক ডলার খরচ করা হলে ১০ ডলালের ফলাফল পাওয়া যাবে। এজন্য হেলথ ফাউন্ডেশন প্রয়োজন। দীর্ঘ মেয়াদী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা করা দরকার।’
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সের (বিইউএইচএস) হেল্থ প্রমোশন অ্যান্ড হেলথ এডুকেশন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক খোরশেদা খানম বলেন, ‘শিক্ষার জন্য সব উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী ঠিক মতো পড়তে পারে না। আমরা স্কুলতো বানিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এ অবস্থা কেন? শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা নয়, বরং শিক্ষা দেয়া হোক। শিক্ষার মান বাড়ানো দরকার। শিক্ষাই তাকে বলে দেবে সে কী করবে। সেদিকেই খেয়াল রাখতে হবে।’
তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘আপনারা চারটি স্তরে কাজ করতে পারেন। সংসদ সদস্য, হেলথ সেন্টার, মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের মাধ্যমে কাজটি এগিয়ে নিতে পারেন। ছোটবেলা থেকেই এ কাজ প্রতিটি শিশুর মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে। বিশেষ করে পরিবারিকভাবে শিক্ষা দিলেই তামাক দ্রব্য থেকে তাদের রক্ষা করা সম্ভব। আর বড়দের মধ্যে যারা খায় তাদেরকে ধরে ধরে কাজ করতে হবে। চাকরিতে বিবেচনার ক্ষেত্রে ধূমপান বিষয়টি যুক্ত করা দরকার।’
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান ও টিসিআরসির আহ্বায়ক ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘এখন একটা বিল ড্রাফট করার সময় এসেছে। একদিন না একদিন এটা পাস হবে। আজ আমরা শিশুদের খেলার জায়গা দিতে পারি না। এজন্য ক্রাইম সংগঠিত হয়।’
তিনি বলেন, ‘পদ্ম সেতুর আগে যদি একটা হেলথ ফাউন্ডেশন গঠন করা যেতো তাহলে চিকিৎসা খাত থেকে যে টাকা বাঁচতো তা দিয়ে আরো দুটি পদ্মাসেতু নির্মাণ করা যেতো। আমরা দীর্ঘদিন বাঁচতে চেষ্টা করিনি, তাই এখন দ্রুত মরছি।’
অনুষ্ঠানে প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট ফোরামের নির্বাহী পরিচালক সাংবাদিক নিখিল ভদ্র বলেন, ‘তামাক দ্রব্যের সারচার্জ একভাগ থেকে বাড়িয়ে এর বড় অংশ তামাক নিয়ন্ত্রণে ব্যয় করতে পারি। আমরা অসুস্থ হবো না। আমরা চাই সবাই নিরাপদ থাকুক। এজন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জোরদার করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সপ্তম সংসদে যখন সরকার তামাক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে আইন তৈরি করতে চেয়েছে তখন ১৯০ জন সংসদ সদস্য তামাক দ্রব্যের সাথে সম্পৃক্ত শ্রমিকরা বেকার হবে উল্লেখ করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত স্মারকলিপি দেয়। এখন কিন্তু সেটা নেই। সবাই চায় এই তামাক বন্ধ হোক।’
বাংলামেইলের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট রতন চন্দ্র বলো বলেন, ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই আমরা এ ধরনের সেমিনারের আয়োজন করেছি। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন- ২০৪০ সালের মধ্যে তামাক নিষিদ্ধ করা হবে। আমরাও চাই তা হোক। তামাকমুক্ত সমাজ গঠনই আমাদের প্রেরণ।’
সাংবাদিক শ্যামক কান্তি নাগ বলেন, ‘ধূমপানে ক্যানসারের সংখ্যা বাড়ে। এর প্রতিরোধ ব্যবস্থায় হেলথ ফাউন্ডেশন গঠন করা প্রয়োজন।’
সভাপতির বক্তব্যে বাংলামেইলের ম্যানেজিং এডিটর আম্মাদুর রহমান আরমান বলেন, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সচেতনতা প্রয়োজন। যিনি ধূমপান করবেন তাকেই সচেতন হতে হবে।’ এ সময় তিনি তামাকের ওপর বেশি ট্যাক্স আরোপ করারও দাবি জানান।
সেমিনারে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের প্রোগ্রাম ম্যানেজার সৈয়দা অনন্যা রহমান। তিনি বলেন, ‘আজ তামাক উন্নয়ন বোর্ড থেকে তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল হয়েছে। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য ইতিবাচক।’