রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নিষিদ্ধ পলিথিন। এ ছাড়া এক ধরনের রঙিন পলিথিনের টিস্যু (যা চায়না টিস্যু নামে পরিচিত) ব্যাগে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিথিন নিষিদ্ধ করতে আইনের কঠোর বাস্তবায়নের দাবীতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), ওয়ার্ক- ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টসহ ১7 টি সংগঠনের উদ্যোগে ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫, বুধবার, সকাল ১১টায় শাহবাগস্থ চারুকলা অনুষদের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন পেশাজীবি, পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ হাজার হাজার নারী তাদের শিশু সন্তান নিয়ে মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেন।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, পবার নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও নাসফের সভাপতি হাফিজুর রহমান ময়না, সমন্বয়কারী আতিক মোরশেদ, কেরানীগঞ্জ শপিং ব্যাগ ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লি: এর সভাপতি মো: সাধারণ সম্পাদক মো: ছিদ্দিকুর রহমান, সমিতির অন্যতম সংগঠক মো: শহীদুল আলম, নারী নেত্রী মোছা: বাছিরন, পল্লীমা গ্রীণের সদস্য সচিব আনিসুল হোসেন তারেক, ঢাকা মহানগর ইনভেলপ প্রস্তুতকারক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো: বাপ্পী, কাগজ ব্যবসায়ী রতন মজুমদার, পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটির সভাপতি বুরহান উদ্দিন আহমদ, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন, ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর সিনিয়র প্রকল্প কর্তকর্তা জিয়াউর রহমান, ইয়থ সানের সভাপতি মাকিবুল হাসান বাপ্পী, জনউদ্যোগের সদস্য হরেন্দ্র নাথ সিংহ, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, বন্ড লাইসেন্সের মাধ্যমে আমদানীকৃত পলি প্রোপাইলিন অবৈধভাবে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরীতে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসেবে শুধুমাত্র ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় এক কোটি ৪০ লাখের বেশী পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার শেষে ফেলে দেয়া হয়। এগুলো দ্বারা ড্রেন, নালা-নর্দমা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয় এবং সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। এসব ব্যাগ দেখতে কাপড়ের মতো হলেও আগুনে গলে যাচ্ছে। বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গবেষণায় টিস্যু ব্যাগে পলিথিনের মতো পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, ফ্যাশন হাউজ, কাপড়ের দোকানসহ বিভিন্ন কোম্পানি টিস্যু ব্যাগ ব্যবহার করছে।
পলিথিনে মোড়ানো গরম খাবার গ্রহণ করলে ক্যান্সার ও চর্মরোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। পলিথিনে মাছ ও মাংস প্যাকিং করা হলে অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়, যা মাছ ও মাংস দ্রুত পঁচনে সহায়তা করে। পিভিসি এবং অন্যান্য প্লাষ্টিক জাতীয় আবর্জনা ৭০০ সে. তাপমাত্রার নিচে পোড়ালে ডাইঅক্সিন জাতীয় বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি হয় যা জন্মগত ত্রুটি, চর্মরোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি মারাতœক রোগের জন্য দায়ী; ওভেনপ্রুফ প্লাষ্টিক কনটেইনার খাবার গরম করলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে খাবারে ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক, সীসা মিশে যায় যার ফলে মরাত্মক রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে; পলিথিন থেকে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়া ত্বকের বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয়, যা থেকে এমনকি ডায়রিয়া ও আমাশয় ছড়াতে পারে।
আবু নাসের খান বলেন, পলিথিন নিষিদ্ধের আইন দেশের জনগণ সানন্দে গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়নের ফলে পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে বর্তমানে আইনটি কার্যকর হচ্ছে না। পলিথিনের ব্যবহার সাম্প্রতিক সময়ে আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কোন কার্যকর তৎপরতা এবং মনিটরিং না থাকায় নিষিদ্ধ পলিথিন এবং টিস্যু ব্যাগে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। একই সঙ্গে রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলা, আন্তরিকতার অভাব ও উদাসীনতা।
পৃ-১
প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান বলেন, পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগ ব্যবহারের ফলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির পাশাপাশি কাগজ ও কাপড়ের ব্যাগের চাহিদা কমে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে পরিবেশবান্ধব পাটের কদর, কমছে পাট চাষ। বন্ধ হচ্ছে কাগজ, পাট ও কাপড়ের ব্যাগের কারখানা। বেকার হচ্ছে কুটিরশিল্পের মালিক ও শ্রমিক-কর্মচারীরা। সারা বিশ্বে পাটের চাহিদা বাড়লেও আমাদের অবহেলা ও সচেনতার অভাবে সোনালি আঁশ পাট আজ বিলুপ্তির পথে। আমাদের এ শিল্পকে ফিরিয়ে আনতে সরকারকে কার্যকর ভ’মিকা পালন করতে হবে এবং জনগণকে সচেতন হতে হবে। পলিথিন নিষিদ্ধ আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে, কাগজ, পাট ও কাপড়ের ব্যাগের ব্যবহার বাড়বে, মাঠ পর্যায়ে কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাটের ব্যাগ আমেরিকায় রফতানির উদ্যোগ নেয়া হলে রফতানি আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষক পাট চাষে উৎসাহিত হবে এবং পাটের ন্যায্য দাম পাবে। বাংলাদেশ সোনালী আঁশ পাটের ঐতিহ্য ফিরে পাবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (২০০২ সনের ৯ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ৬ক ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার সকল বা যে কোন প্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ, বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরী অন্য কোন সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলে, এরূপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আদালত আইন, ২০০০ (২০০২ সনের ১০ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ২(খ) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পলিথিন শপিং ব্যাগ সংক্রান্ত অপরাধসমূহের ব্যাপারে অনুসন্ধান, কোন স্থানে প্রবেশ, কোন কিছু আটক, আনুষ্ঠানিক তদন্ত ও অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ এবং প্রয়োজনবোধে পরিবেশ আদালতে মামলা দায়েরের উদ্দেশ্যে মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশের এস আই/সমপর্যায় হতে এ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার অব পুলিশ পর্যন্ত; মেট্রোপলিটন বহিভর্’ত এলাকায় এস আই/সমপর্যায় হতে সহকারী পুলিশ সুপার পর্যন্ত পুলিশ কর্মকর্তাগণকে ০৪ মে ২০০২ তারিখের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে উক্ত আইনে সংজ্ঞায়িত “পরিদর্শক” এর ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
আমাদের দাবী-
* পলিথিন নিষিদ্ধের আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।
* পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাট, কাপড়, কাগজের ব্যাগ ও ঠোংগা ব্যবহার করা ও এগুলো সহজলভ্য করা এবং এসব ব্যাগ ও ঠোংগা ব্যবহারে জনগণকে উদ্ভুদ্ধ করা।
* পলিথিন শপিং ব্যাগ তৈরীর কাঁচামাল আমদানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং বন্ড লাইসেন্সের মাধ্যমে আমদানিকৃত পলি প্রোপাইলিন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।
* পরিবেশ অধিদপ্তর, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, এফবিসিসিআই, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। এক্ষেত্রে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় কার্যকর ভ’মিকা পালন করতে পারে।