বাংলাদেশের মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুনের ও বেশী লবন গ্রহণ করায় মানব দেহে উচ্চ রক্তচাপের ঝুকিঁ আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলাফল হিসেবে শারীরিক অক্ষমতা, হৃদরোগ ও ষ্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ছে। সুস্থ জীবন-যাপনের জন্য প্রতিদিন খাবারে লবনের পরিমাণ অর্ধেকে নামিয়ে আনা প্রয়োজন। খাদ্যে লবনের পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য পাতে আলাদা লবন পরিহার, তরকারিতে লবনের ব্যবহার কমানো এবং প্যাকেট খাবারে লবনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রক্রিয়াজাত খাবারে লবণের ব্যবহার নিয়ন্ত্রনে নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়নের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের উদ্যোগে ২২ নভেম্বর ২০১৫, সকাল ৯টা থেকে দূপুর ২টা পর্যন্ত ঢাকাস্থ কৃষিবিদ ইনিষ্টিটিউশন অব বাংলাদেশ, (কেআইবি), খামারবাড়ী, মিলনায়তনে “অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে খাদ্যাভাসে অতিরিক্ত লবণ পরিহার” শীর্ষক একটি সেমিনারে বিশেষজ্ঞগণ এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
নাটাব এর জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মোজাফফর হোসেন পল্টু এর সভাপত্বিতে সভায় বক্তব্য রাখেন ডা. মোস্তফা জামান, ন্যাশনাল প্রোফেশনাল অফিসার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা; অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী, পরিচালক, ল্যাবটারি সার্ভিস বারডেম; সাইফুদ্দিন আহমেদ, নির্বাহী পরিচালক, ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট; অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন; অধ্যাপক ডা. এ. এইচ. এম এনায়েত হোসাইন, লাইন ডিরেক্টর এনসিডি কন্ট্রোল, ডিজিএইচএস। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ এন্ড সাইন্স এর উপাচার্য অধ্যাপক ড. লিয়াকত আলী।
অধ্যাপক ড. লিয়াকত আলী বলেন, বেঁচে থাকার জন্য আমাদের শরীরে প্রতিদিন লবণের দরকার। কিন্তু অপ্রয়োজনের অতিরিক্ত লবন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত লবণ খেলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। উচ্চ রক্তচাপ বিশ্বে প্রতিবছর ৯০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটায়। মজবুত হাড়ের জন্য ক্যালসিয়াম অমূল্য উপাদান। কিন্তু অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করলে টৎরহব-এর মাধ্যমে ক্যালসিয়াম শরীর থেকে বের হয়ে যায়। যার ফলে আমাদের হাড়ের ক্যালসিয়াম ক্ষয় হয়ে হাড় পাতলা হয়ে যায়। গবেষণায় এখন প্রমাণিত উচ্চ মাত্রায় লবণ গ্রহণ ক্যান্সারের ঝুকি বাড়ায়। সুস্থ জীবন যাপনের জন্য আমাদের মাত্রাতিরক্ত লবণ গ্রহণ পরিত্যাগ করতে হবে। অতিরিক্তি লবনের সঙ্গে রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজও ঢুকে পড়ে, সেটিও স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
ডা. শুভাগত চৌধুরী বলেন, জীবনাচারে অসংগতির জন্য অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। সুস্থ থাকতে হলে পরিমিত পরিমানে খেতে হবে,শরীর চর্চ্চা করতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের পাশাপাশি সুস্থ থাকার অন্যতম মন্ত্র জীবনকে আনন্দময় করে তুলতে হবে। হাসি সুস্থ্য থাকার অন্যতম ঔষধ। তরুণদের মাঝে রক্তচাপ ও ক্যান্সার ব্যাপক পরিমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবণ নিয়ন্ত্রণে শুধুমাত্র সচেতনতা নয় এর পাশপাশি আইন প্রণয়ন করতে হবে।
ডা. মোস্তফা জামান বলেন, আমাদের স্বাস্থ্যখাতে সফলতা অনেক। এটি ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে লবন গ্রহনের মাত্রা ৩০ ভাগ কমিয়ে আনার লক্ষ্য নিধারণ করেছে। বাড়তি কাঁচা লবণ বা পাতে লবণ পরিহার করুন। প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন চিপস, ক্রেকার্স, কেচআপ, লবণ-বাদাম, পনির ইত্যাদি প্রক্রিয়াজাত খাবারে দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য সোডিয়াম মেশানো হয় । তাই প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পরিহারের পাশাপাশি শশা, বরই, তেঁতুল, কাঁচা আম, আমলকী, আমড়া, জলপাই এ জাতীয় ফল লবণ দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করুন।
সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ১৯৬০ সালে জাপানে প্রতিদিন ১৫-১৬ গ্রাম লবন গ্রহণ করত। তখন জাপানে মৃত্যুর হার বেশি ছিল। বর্তমানে জাপানে লবনের ব্যবহার কমিয়ে আনায় স্ট্রোকে মৃত্যুর হার ৮০% ভাগ কমেছে। সুস্থ্য থাকতে হলে প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় ফলমূল্যে, শাক সবজির পরিমান বাড়াতে হবে।
সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশেষজ্ঞদের মতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি দিনে ৬ গ্রাম বা তারও কম লবণ গ্রহণ করতে পারেন। আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কয়েক গুণ বেশি লবণ গ্রহন করছি। প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণের পরিবর্তে অবশ্যই নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় তাজা ফলমূল,শাক সবজি অর্ন্তভুক্ত করতে হবে।
মোজফফর হোসেন পল্টু বলেন, আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় লবণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য উপাদান। এটি দেহের জলীয় অংশের সমতা রক্ষা করে, আবার পেশির সংকোচন, দেহের মধ্যস্থিত সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের মধ্যেও সমতা রক্ষা করে। অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের ফলে বিভিন্ন রোগ হতে পারে।
এ.এইচ.এম এনায়েত হোসাইন বলেন, সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের যৌথ ও আন্তরিক উদ্যোগ দেশে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে। দেশ সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধে বিশেষ সফলতা অর্জন করেছে। এবার অসংক্রামক রোগ বিস্তারে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
সারাদেশের সাতটি বিভাগে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে কার্যরত ১৭০টির অধিক সংগঠনের সাথে জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে খাবারে অতিরিক্ত লবণ পরিহারের প্রয়োজনীয়তা ও করনীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে সেমিনার আয়োজন করা হয়।