আমাদের নগরায়ন ব্যবস্থা এমন যা আমাদের পরিবেশকে ক্রমাগত দূষিত করছে এবং বাড়িয়ে চলেছে আমাদের অপচয়ের মাত্রা। আমাদের ভবনগুলো যেভাবে তৈরি হচ্ছে সেখানে প্রাকৃতিক আলো, বাতাসের কোন ব্যবস্থা নেই। ফলে বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ পরিকল্পনায় সামান্য পরিবর্তন আনরেই এ অবস্থার পরিবর্তন আনা সম্ভব। অনগরায়নের অন্যতম অংশ হিসেবে আমরা ব্যক্তিগত গাড়িকে প্রাধান্য দিচ্ছি। ফলে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা অত্যধিকভাবে বেড়ে গেছে। ফলে বাড়ছে যানজট এবং সেই সাথে বাড়ছে জীবাশ্ম জ্বালানি এবং মূল্যবান কর্মঘন্টার অপচয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সকল ধরণের উপযোগের ব্যবহার এবং অপচয়। ঢাকা শহরে ২৩,০০০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগনায়ন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক এবং শারীরিক বিকাশেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ২০১৪ সালের হিসাবে বাংলাদেশের ৩৩% জনগণ নগরের বাসিন্দা এবং সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৮০ লক্ষ লোক বসবাস করে অথচ পরিকল্পিতভাবে নগর গড়ে উঠছে না। আজ সকাল ১১ টায় পরিবেশ অধিদপ্তর, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), বাংলাদেশ ইনিস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বি.আই.পি) এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর উদ্যোগে বন বিভাগের হৈমন্তী সম্মেলন কক্ষে “নগর জীবন ও অপচয় রোধে করণীয়” শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তরা এই অভিমত ব্যক্ত করেন।
শুভেচ্ছা বক্তব্যে ড. সুলতান মাহমুদ, যুগ্ম সচিব, পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তরের (প্রাকৃতিক সম্পাদ ব্যবস্থাপনা) বলেন, আমাদের উন্নয়নের ধারা এবং সম্পদ ব্যবহারের মাত্রায় পরিবর্তন না আনি তাহলে আমাদের সীমিত সম্পদ দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবে। নগরে উন্নয়নের নামে আমরা শহরকে কংক্রিট দিয়ে ঢেকে ফেলছি। ফলে আমাদের নগরের উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় সম্পদ ব্যবহারেও আমরা দায়িত্বশীল নই। প্রতিদিন ঢাকা শহরে ২০-৩০ শতাংশ খাবার অপচয় হয়। আমাদের চিন্তা, চেতনায় এবং সর্বপরি পরিকল্পনায় এ বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে।
প্রবন্ধ উপস্থাপনায় মারুফ হোসেন, ন্যাশনাল এডভোকেসি অফিসার, ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট বলেন, বিশ্বের বিখ্যাত মনীষিগন সম্পদের সীমিত ব্যবহার এবং সংরক্ষনের উপর তাগিদ দিয়েছেন। এয়ার কন্ডিশন ব্যবহারের ফলে বর্তমানে মোট বিদ্যুতের ২০% অর্থাৎ ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে । অথচ যথাযথ ভবন নির্মাণ কৌশল অনুসরণের মাধ্যমে এ খরচ হ্রাস করা সম্ভব। তিনি নগরের যাতায়াতের কথা উল্লেখ করে বলেন প্রতিদিন অপরিকল্পিতভাবে নতুন নতুন গাড়ি রাস্তায় নামছে ফলে নগরে উষ্ণতা ও দূষণ বাড়ছে। অথচ ফুটপাত ভালো করে, গণপরিবহন ও অযান্ত্রিকযানের ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের যাতায়াত ব্যয় এবং দূষণ কমানো সম্ভব।
ড. আকতার মাহমুদ, সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ ইনিস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স বলেন, আমাদের নগর পরিকল্পনায় বিকেন্দ্রিকরনের কথা বললেও বাস্তবসম্মত কোন পরিকল্পনা গৃহিত হয়নি। আমরা জলভূমি দখল করে অবকাঠামো তৈরি করার ফলে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানির উৎসগুলো হারাচ্ছি এবং দিনে দিনে ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন আমরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে পানির জন্য প্রকল্প নিচ্ছি। অথচ পরিকল্পিতভাবে নগরায়ন হলে এ অপচয়রোধ করা সম্ভব হত।
মুহাম্মদ মউদুদউর রশীদ সফদার, পরিচালক, (ঢাকা মেট্রো) পরিবেশ অধিদপ্তর বলেন, আমাদের গ্রামগুলোকে প্রাধান্য না দিয়ে শুধু শহর কেন্দ্রিক করা হচ্ছে। ফলে ভাগ্যের অšে¦ষনে মানুষ ঢাকামুখী হয়ে পড়ছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠিকে ধারন করতে গিয়ে ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সম্পদের অপচয় বেশি হচ্ছে। সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে গ্রামের তুলনায় নগরের তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। তবুও আমরা ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের কোন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছি না।
কাজী সরোয়ার ইমতিয়াজ হাসমি, ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর বলেন, আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে যেটুকু সম্পদ পেয়েছি , তা আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারছি না। আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সম্পদ ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। এটুকু অবদান যদি আমরা রাখতে পারি তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম লাভবান হবে।
প্রধান অতিথি এ এম এম শফিউল্লাহ, উপাচার্য্য, আহসানউল্লাহ্ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বলেন, ২০১৪ সালের হিসেবে ৫৪ শতাংশ বিশ্ব জনসংখ্যা নগরের বাসিন্দা এবং ২০৫০ সাল নাগাদ তা দাঁড়াবে ৬৬ শতাংশ। এ অবস্থায় আমাদের এখন সুষ্ঠ নগরায়ন ব্যবস্থায় জোড় দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমরা নদী কেন্দ্রিক নগরায়ন থেকে সরে এসে এখন বাঁধ কেন্দ্রিক নগরায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছি। ফলে ঢাকাকে বন্যা থেকে কিছুটা রক্ষা করা সম্ভব হলেও পানিবাহিত পলি মাটির অভাবে ঢাকায় কৃষি উন্নয়ন অনুপস্থিত। যে বাঁধ দিয়ে আমরা ঢাকাকে রক্ষা করছি তা হয়তো আগামীতে সম্ভব হবে না। কারণ প্রতি বছর বন্যায় পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সেমিনারে সভাপতি আবু নাসের খান, চেয়ারম্যান, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) বলেন, নগর পরিকল্পনায় ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ায় ঢাকা একটি পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে উঠছে না। নাগরিক জীবনের সর্বত্রই এর প্রভাব পড়ছে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সকল বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে হওয়া প্রয়োজন। প্রকল্পগুলোকে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অনুমতি নিতে হবে। তারা যথাযথ মূলায়ন করে তবেই অনুমোদন দিবে। এর মাধ্যমে উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষা সম্ভব হবে।
অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর ন্যাশনাল এডভোকেসি অফিসার মারুফ হোসেন এবং সঞ্চালনা করেন দ্য ইউনিয়ন এর কারিগরি পরামর্শক সৈয়দ মাহবুবুল আলম।