নেতিবাচক খাদ্যভ্যাস ও জীবনাচার, ধূমপান ও তামাকের নেশা, মাদকের নেশা এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের প্রভাবে বাংলাদেশ অসংক্রামক রোগ (হৃদরোগ, স্ট্রোক, বিভিন্নরকম ক্যান্সার, ডায়বেটিস) অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ২০১০ সালে জাতীয়ভাবে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ৯৮.৭% মানুষের মধ্যে অন্তত একটি, ৭৭.৪% অন্তত দুটি এবং ২৮.৩% এর মধ্যে তিনটি অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস যথাক্রমে ১৭.৯% এবং ৩.৯% মানুষ এ আক্রান্ত হচ্ছে।
অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল, দীর্ঘমেয়াদী, মৃত্যুঘাতী হলেও ভাল হবার সম্ভাবনা কম হওয়ায় এসব রোগ প্রতিরোধকে গুরুত্ব দেয়া হয়। রোগ প্রতিরোধকে গুরুত্ব দিয়েই সরকার জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন করেছে এবং জাতিসংঘ অসংক্রামক রোগ বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলন করেছে, যেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ অংশ নিয়েছিল। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির বাস্তবায়ন, বৈশ্বিক পরিমন্ডলে রোগ প্রতিরোধে বাংলাদেশের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন এবং জনস্বাস্থ্য উন্নয়নকে প্রাধান্য দিতে ‘হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন’ গঠন জরুরি।
২৫ মে, ২০১৫ সকাল ১১টায় ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্ট এর উদ্যোগে সংস্থার কৈবর্ত সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ উপরোক্ত পরামর্শ প্রদান করেন। আসন্ন বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০১৫ (৩১ মে) উদযাপন উপলক্ষে ‘তামাকের অবৈধ ব্যবসা বন্ধ ও হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের সমন্বয়কারী সাইফুদ্দিন আহমেদ। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য ও বিশ্বস্বাস্থ্য) রোকসানা কাদের। আলোচনা করেন ইউনাইটেড ফোরাম এগেইনেস্ট টোব্যাকো (উফাত) এর সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী ও ফ্রান্সভিত্তিক জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান দি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন এগেইনেস্ট টিউবরকুলোসিস এন্ড লাং ডিজিজ (দি ইউনিয়ন) এর কারিগরি পরামর্শক এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম। সভায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আন্তর্জাতিক অঙ্গণে খ্যাতিমান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কানাডাভিত্তিক জনস্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠান হেলথব্রিজ এর আঞ্চলিক পরিচালক দেবরা ইফরমসন।
প্রবন্ধে দেবরা ইফরমসন বলেন, মানুষ যেন সুস্থ্য থাকে, সেরকম পরিবেশ অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। এজন্য ক্ষতিকর খাবার নিরুৎসাহিত করতে রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিতে হবে। তামাকের উপর স্বাস্থ্যকর আরোপ করা হয়েছে, এটা খুবই ইতিবাচক। পাশাপাশি ক্ষতিকর কোমল পানীয়, মোড়কজাত কেমিকেল জুস ও এনার্জি ড্রিংক্স, জাঙ্কফুড (চিপস ও ফ্রোজেন খাবার ইত্যাদি) ও ফাস্টফুড, পরিবেশ দূষণকারী প্লাস্টিকের বোতলজাত পানি ও ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেট কার) এর উপরও স্বাস্থ্যকর আরোপ জরুরি। স্বাস্থ্যকর হিসাবে অর্জিত অর্থ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন গঠন জরুরি। থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এরকম ফাউন্ডেশন রয়েছে এবং রোগ প্রতিরোধে কাজ করছে।
রোকসানা কাদের বলেন, সরকার রোগ প্রতিরোধকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তামাক নিয়ন্ত্রণও এর অংশ। তামাকজাত দ্রব্যের উপর আরোপিত স্বাস্থ্যকর কিভাবে ব্যয় হবে, সেটা এখনও চুড়ান্ত হয়নি। তবে স্বাস্থ্য কর রোগ প্রতিরোধে কাজে লাগানোর জন্য হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন গঠনের প্রস্তাব ইতিবাচক, এটা আমরা বিবেচনা করব। পাশাপাশি তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর আরও বাড়ানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আগামী ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এ দিবসকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার সহযোগিতায় সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ কাজ এগিয়ে চলছে।
অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন এর প্রস্তাব সমর্থন করে বলেন, লবন, চিনি ও চর্বিযুক্ত সব খাবারের উপর স্বাস্থ্যকর আরোপ করা দরকার। স্বাস্থ্যকর রোগ প্রতিরোধেই ব্যয় হওয়া উচিত। এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, মানুষ অসুস্থ্য হলে ব্যক্তিগত ও জাতীয় উৎপাদনে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই যে কোন দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে রোগ প্রতিরোধকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়।
সভাপতির বক্তব্যে সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো নানাভাবে কর ফাঁকি দেয়। সিগারেটের চোরাচালানের সঙ্গে কোম্পানিগুলোর সম্পৃক্ততা রয়েছে। আইন অনুযায়ী বাংলায় লিখিত স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ব্যতিত সিগারেটসহ কোন তামাকজাত দ্রব্য বাংলাদেশে বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু বাজারে অবৈধ বিদেশি সিগারেট পাওয়া যায়। সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্যের চোরাচালন বন্ধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া দরকার।
বক্তারা বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণে আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। পাশাপাশি প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। তামাক কোম্পানিগুলো নানাভাবে আইন লঙ্গণ করছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা দরকার।
ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর কর্মসূচি সমন্বয়ক আমিনুল ইসলাম সুজন-এর সঞ্চালনায় মুক্ত আলোচনায় বক্তব্য রাখেন একশান ইন ডেভেলপমেন্ট (এইড) এর নির্বাহী পরিচালক আমিনুল ইসলাম বকুল, নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানা, গ্রাম বাংলা উন্নয়ন কমিটির নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাকসুদ, নারীপক্ষ’র কর্মসূচি ব্যবস্থাপক সামিয়া আফরিন, টোব্যাকো কন্ট্রোল রিসার্চ সেল (টিসিআরসি) এর সদস্য সচিব ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক মো. বজলুর রহমান, একলাব এর পরিচালক মো. শামসুল আলম, জাতীয় যক্ষা নিরোধ সমিতি (নাটাব) এর কর্মসূচি ব্যবস্থাপক এ কে এম খলিল উল্লাহ প্রমুখ।