ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে অতিসত্ত্বর হাঁটার উপযোগী পরিবেশ ও পাবলিক বাসের সোবামান বৃদ্ধি জরুরী। হেঁটে চলাচলে সবচেয়ে কম জায়গা লাগে এবং বাসে অল্প জায়গায় বেশি মানুষ পরিবহণ করা যায়। হেঁটে চলাচলের সুবিধা ও বাসের সংখ্যাগত এবং সেবামান বাড়ানো হলে প্রাইভেট কারের উপর নির্ভরশীলতা কমবে। যা যানজট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। প্রাইভেট কার বেশি জায়গা নেয় যাত্রী পরিবহণ করে খুবই সামান্য। ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৯ সকাল ১১.০০টায় সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট আয়োজিত “ঢাকা মহানগরীর অসহনীয় যানজট: বাস্তবমূখী সমাধানের রূপরেখা” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বিশেষজ্ঞগণ একথা বলেন।
আন্তর্জাতিক পরিবহণ বিশেষজজ্ঞ ড. মাহবুবুল বারী মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ঢাকার পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নে মানুষকেন্দ্রিক নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, গাড়িকেন্দ্রিক নয়। কিন্তু এসটিপিসহ সকল বিদ্যমান নীতি ও পরিকল্পনায় প্রাইভেট কারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যা বাস্তবায়ন হলে পরিবহণ ব্যবস্থায় ভয়াবহ সঙ্কট দেখা দেবে এবং পচানব্বই শতাংশ মানুষ পরিবহণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এসটিপি গবেষণায় দেখা যায়, পঞ্চাশ শতাংশ যাতায়াত হয়ে থাকে হেঁটে এবং রিকশায়। এই দুইটি মাধ্যমে চলাচলের উন্নয়নে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র একশত চল্লিশ কোটি টাকা যা এসটিপি এর মোট বরাদ্দের ০.৪ শতাংশ। অথচ পাতাল রেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৯৩ শতাংশ যা প্রায় ৩১ হাজার কেটি টাকা। এ দুইটি প্রকল্প থেকে খুবই নগন্য সংখ্যক মানুষ যাতায়াত সুবিধা পাবে। বর্তমানে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেস মূলত প্রাইভেট কারবান্ধব অবকাঠামো। ঢাকা শহরে এখন পর্যন্ত ৫ শতাংশের নীচে প্রাইভেট কারের মালিকানা, এই অল্প সংখ্যক মানুষের কথা চিন্তা করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হলে হিতে বীপরীত হবে। বর্তমানে বিশ্বের সকল উন্নত শহরে এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করা থেকে বিরত রয়েছে। এছাড়া তিনি সিউলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ভাঙ্গার উদাহরণ তুলে ধরেন।
বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব-উন-নবী বলেন, নগর পরিকল্পনার সঙ্গে পরিবহণ পরিকল্পনার সমন্বয় করার জন্য একই সংস্থার অধীনে এ কাজটি করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি পাতাল রেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হলে দেশের অর্থনীতিতে ধস নামবে বলে মন্তব্য করেন। বিশ্বের সকল দেশেই পাতাল রেল ভর্তূকি দিয়ে চালানো হয়, যা আমাদের মতো রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। ড. এটিএম নূরুল আমিন বলেন, ঢাকার যানজট নিরসনে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া প্রয়োজন প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করা। এখন অনেকেই প্রাইভেট কার ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন। বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. শাকিল আখতার বলেন, চলতি মাসে যানজট নিরসনে “অপারেশন ক্লিন স্ট্রিট” নামক অভিযানে হাজারের অধিক বাস বন্ধ হয়েছে। এতে প্রায় লক্ষ লক্ষ যাত্রী প্রতিদিন ভোগান্তি পোহাচ্ছে। অথচ প্রাইভেট কারের অবৈধ পার্কিং চলছে অবাধে। এ ধরনের অভিযান সফল হতে পারে না।
আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য এম আনোয়ার হোসেন বলেন, এসটিপি সম্পূর্ণ প্রকল্পভিত্তিক একটি পরিকল্পনা হিসেবে রূপ লাভ করেছে। যদিও এর শুরুটা ভালো ছিল। এ ধরনের পরিকল্পনা মানুষের সুবিধা নিশ্চিত করবে না বরং কিছূ ব্যবসায়িক সুবিধা দেবে। এ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড, শামসুল হক বলেন, ঢাকার পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নে নগরকে পরিকল্পিতভাবে বাড়তে দিতে হবে। হাফিজুর রহমান ময়না বলেন, ফুটপাত হাঁটার উপযোগী এবং সড়কের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে ঢাকার যানজট অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বাস মালিক সমিতির সহ-সভাপতি সৈয়দ রেজাউল করিম, রেল লাইনের উপর ওভার পাস নির্মাণ এবং অবৈধ পার্কিং বন্ধ করার সুপারিশ করেন। বাপার মহিদুল হক খান বলেন, পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নে সুফল পেতে হলে এ খাতে কর্মরত সকল সংস্থার মধ্যে সমন্বয় জরুরী। তিনি বলেন, যাতায়াত চাহিদা কমাতে মিশ্র এলাকা তৈরি করা প্রয়োজন। যাতে অল্প দূরত্বের মধ্যে স্কুল, বাসা, বাজার, হাসপাতাল, কর্মস্থল এবং বিনোদন কেন্দ্র গড়ে উঠে। তাহলে বেশিরভাগ যাতায়াত হেঁটে, সাইকেলে এবং রিকশা করেই সম্পন্ন করা যাবে।
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ সভাপতির বক্তবে বলেন, প্রাইভেট কারের নিয়ন্ত্রণ এবং হাঁটার উপযোগী পরিবেশ বাসের সেবামান বৃদ্ধি এবং রেল ও নৌপরিবহণের সমন্বয়ে যানজটমুক্ত সুষ্ঠু পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। গোলটেবিল আলোচনা বাপা’র নগরায়ন এবং সুসাশন প্রোগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব স্থপতি ইকবাল হাবিবের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয়।