পৃথিবীতে একমাত্র বৈধ ব্যবসা তামাক, যে ব্যবসা মানুষকে সরাসরি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। দেশী-বিদেশী বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যে কারণে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তামাকের ব্যবহার ও তামাকজনিত মৃত্যু বাড়ছে। তামাকের ব্যবহার কমাতে উন্নত দেশগুলো জনগণকে তামাক সেবন থেকে দূরে রাখতে ছবিসহ সতর্কবানী প্রদানসহ কঠোর তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণযন করছে। বাংলাদেশেও কঠোর তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন এখন সময়ের দাবি। বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা দূর করতে আইন সংশোধন প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু মৃত্যুঘাতী তামাক কোম্পানিগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনকে বাধাগ্রস্ত করতে নানা ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। তামাকজনিত মৃত্যু কমাতে তামাক কোম্পানির ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে সব পর্যায়ের বেসরকারি সংগঠন, গণমাধ্যম, পেশাজীবী সংগঠনকে তামাক বিরোধী কাজে এগিয়ে আসতে হবে।
২৭ জুন সকাল ১১ টায় ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্ট আয়োজিত জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি সভাকক্ষে এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এই অভিমত ব্যক্ত করেন। বক্তারা আরো বলেন, জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন, মানুষের মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব রোধ ও সুস্থ্য থাকার পরিবেশ নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। তাই তামাক কোম্পানির ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে জনস্বার্থ, জনস্বাস্থ্য ও মানুষের মৃত্যু রোধ করতে অবিলম্বে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। যতদ্রুত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধিত হবে ততই সরকার জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হবে।
ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট পরিচালক এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম এর সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা করেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, বাংলাদেশ মেডিয়েটর এসোসিয়েশনের সভাপতি এবং ইবাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. বেলাল হোসেন জয়, ওশী এর চেয়ারম্যান সাকী রেজওয়ানা, সেভ দ্যা কোস্টাল পিপল (স্কোপ) এর নির্বাহী পরিচালক কাজী এনায়েত হোসেন এবং প্রশিকা মানবসম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র (এইচআরডিসি) ট্রাস্ট’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ পাঠ করেন ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর ন্যাশনাল এডভোকেসি অফিসার সৈয়দা অনন্যা রহমান।
পরিবেশবিদ আবু নাসের খান বলেন, তামাকের কারণে লাভবান হয় কোম্পানির মালিকগণ আর ক্ষতিগস্থ হয় চাষী, উৎপাদনে নিয়োজিত শ্রমিক এবং ব্যবহারকারী। তামাকের জমিতে ব্যবহার করা হয় অতিরিক্ত কীটনাশক ও সার, ফলে দ্রতু তামাক চাষের জমি উর্বরতা হারায়। পাহাড়ের ঢালু জমিতে তামাক চাষ করায় কীটনাশক ও তামাকের বিষ গিয়ে নদীর পানিতে পড়ছে। এতে পানি দূষিত হয় ও পার্বত্য এলাকায় মাছের আধার নষ্ট হচ্ছে। তামাক প্রক্রিয়াজাত করার জন্য ব্যাপক হারে বনাঞ্চল ধ্বংসসহ নির্বিচারে বৃক্ষনিধন করা হচ্ছে। তামাক হচ্ছে সর্বগ্রাসী একটা পণ্য। তাই তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করাসহ অবিলম্বে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা দরকার।
অধ্যাপক ড. বেলাল হোসেন জয় বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণকে বাধাগ্রস্ত করতে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তামাক কোম্পানির কেউ কেউ নীতি নির্ধারণের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। যে কারণে তামাকের বিরুদ্ধে শক্ত নীতি বা আইন প্রণয়ন প্রায়শ বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্য তামাকের ক্ষতিকর বিষয়ে প্রচারণা বৃদ্ধি করতে গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া তামাকের ক্ষতিকর বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে পরিবার থেকে রাষ্ট্রের সর্বত্র তামাকের ক্ষতিকর বিষয়ে প্রচারণা চালাতে হবে।
সাকী রেজওয়ানা বলেন, বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সম্পর্কে সব শ্রেণী পেশার মানুষ যেন শ্রদ্ধাশীল হয় এটা লক্ষ্য রাখতে হবে। এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, প্রতিবছর তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে ৫৭,০০০ হাজার লোক মারা যায়, ৩৮২০০০ লোক পঙ্গুত্ব বরণ করে এবং সরকারের চিকিৎসাখাতে ব্যয় করতে হয় ১১০০০ কোটি টাকা। এই বিশাল মানব সম্পদ ও আর্থিক ক্ষতিকে কোনভাবেই অবহেলা করা সম্ভব নয়। শহিদুল ইসলাম বলেন, নেশাগ্রস্তদের ভাল কাজের প্রতি অনীহা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। সরকারি ও বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানেই অধূমপায়ী ও তামাক সেবন করেন না এমন মানুষদের নিয়োগ দিতে হবে।
প্রবন্ধে সৈয়দা অনন্যা রহমান বলেন তামাকজনিত রোগ হতে রক্ষায় তামাকজাত দ্রব্যের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সবরকম বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, শতভাগ ধূমপানমুক্ত পাবলিক প্লেস ও পরিবহন, প্যাকেটের গায়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবানী নিশ্চিত, তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ, তামাক ত্যাগে সহযোগিতা প্রদান করা এবং আইন ভঙ্গ করলে তামাক কোম্পানিকে কঠোর শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা দরকার। এক্ষেত্রে অবশ্যই পরিবেশ, কৃষি ও মানুষের অধিকার রক্ষিত হবে, এমন বিষয় তুলে ধরে আইন সংশোধনের সমর্থনে জনমত সৃষ্টি করতে হবে।
ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর প্রকল্প সমন্বয়কারী আমিনুল ইসলাম সুজন এর সঞ্চালনায় মুক্ত আলোচনায় বক্তব্য রাখেন জাতীয় অধূমপায়ী ফোরাম সিনিয়র সহ-সভাপতি মাহিদুল ইসলাম ও সি.এম.বাহাউদ্দিন, নিরাপদ ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাইদ রানা, প্রত্যাশা মাদক বিরোধী সংগঠনের সেক্রেটারী জেনারেল হেলাল আহমেদ, ইপসার কর্মসূচি ব্যবস্থাপক নাজমুল হায়দার, নিপেন চন্দ্র বালা, উবিনীগের গবেষনা কর্মকর্তা শাহীনুর বেগম, সিরাক বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক এসএম সৈকত।